গুগল গত ২ আগস্ট অনেকটা অপ্রত্যাশিত ভাবে তাদের পরবর্তী ফ্ল্যাগশিপ স্মার্টফোনের ঘোষণা দিয়েছে। অপ্রত্যাশিত এই জন্য বলা হচ্ছে যে আমরা এখনো এই ফোন সম্পর্কে বিস্তারিত জানি না। গুগল পূর্ব নির্ধারিত টেক সাংবাদিক আর ইউটিউব কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে নিউ ইয়র্কে নিয়ে যায় যারা সেখানে পিক্সেল ৬ আর পিক্সেল ৬ প্রো দেখেছেন। Made by Google এর টুইটার একাউন্টে পরবর্তীতে গুগল ১৩ টি টুইটের মাধ্যমে আরও কিছু তথ্য শেয়ার করে। তবে এই ফোন কবে রিলিজ হবে, কত দাম হবে এই সম্পর্কে গুগল এখনো কিছু জানায়নি।
কেন এই ফোন নিয়ে এত আগ্রহ?

প্রতি বছর স্মার্টফোন enthusiast দের মাঝে যে কয়েকটি স্মার্টফোন নিয়ে প্রবল আগ্রহ থাকে পিক্সেল তার মাঝে অন্যতম। এই পিক্সেল ফোন গুলো দিয়েই এন্ড্রোয়েড অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে গুগল তাদের ভিশন শেয়ার করে। পিক্সেল ফোন গুলোতে বরাবরই ডিজাইন এর চাইতে ইউজার এক্সপিরিয়েন্স এর দিকে গুগলের মনোযোগ বেশি থাকে। আর প্রতি বছর পিক্সেল ফোনেই গুগল কিছু না কিছু স্পেশাল ফিচার নিয়ে আশে।
এই বছর পিক্সেল ফোন সিরিজ নিয়ে আগ্রহ মূলত তিনটি কারণে। প্রথমত, এবার গুগল নিজেদের ডিজাইন করা চিপ দিয়ে পিক্সেল ফোন লঞ্চ করছে। এর আগে কেবল মাত্র অ্যাপল, স্যামসং, হুয়াওয়ে এই কৃতিত্ব অর্জন করেছে। দ্বিতীয়ত, প্রায় চার বছর পর প্রথমবারের মতো গুগল পিক্সেল সিরিজের ক্যামেরা হার্ডওয়্যার আপগ্রেড করছে। তৃতীয়ত, গত বছর করোনা ভাইরাসের জন্য পিক্সেল প্রিমিয়াম ফোন লঞ্চ না করে কোয়ালকমের মিড রেঞ্জ চিপ Snapdragon 765 5G দিয়ে একটি মাত্র ফ্ল্যাগশিপ ফোন (পিক্সেল ৫) লঞ্চ করে। তাই পিক্সেল ৬ সিরিজ হবে গুগলের প্রিমিয়াম ফোন ক্যাটাগরিতে কম্পিটিশনে ফিরে আশা।
কেন পিক্সেল ফোন গুলো স্পেশাল?

এবারের পিক্সেল ৬ এবং পিক্সেল ৬ প্রো কে খুবই স্পেশাল বলা হচ্ছে। কারণ এই দুই ফোন দিয়েই গুগল তাদের ফার্স্ট জেনারেশন কাস্টম SoC লঞ্চ করছে যা আগেই উল্লেখ করেছি। Google Tensor নামে এই SoC টি গুগলের পিক্সেল স্মার্টফোনের কথা মাথায় রেখেই ডিজাইন করা। চিপটি Arm আর্কিটেকচার এর উপরে বানানো। এখানে বলে রাখা ভালো যে অ্যাপল এর A আর M সিরিজের SoC, Qualcomm এর SoC, Samsung এর Exynos SoC গুলোও Arm আর্কিটেকচারের উপরে ভিত্তি করে বানানো।
System on a Chip (SoC) হচ্ছে একটা চিপ যার ভেতরে সিপিইউ, জিপিইউ, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিং কোর, সিকিউরিটি মডিউল, ইন্টারনেট মডেম ইত্যাদি একসাথে ইন্টিগ্রেট করা থাকে। আমারা ডেক্সটপ আর ল্যাপটপে সাধারণত যে চিপ গুলো ব্যবহার করি (যেমন: ইন্টেল আই থ্রি, ফাইভ বা সেভেন ইত্যাদি) সেগুলোতে এই মডিউল গুলোর সবগুলো থাকে না কিংবা আলাদা ভাবে থাকে।
Google Tensor SoC নামকরণের কারণ কী?
Tensor নামটি এসেছে গুগলের Tensor Processing Unit (TPU) থেকে। গুগল বিশ্বব্যাপী তাদের Data Center গুলোতে নিজেদের ডিজাইন করা TPU ব্যবহার করে; যা দিয়ে মেশিন লার্নিং ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স রিলেটেড কাজ গুলো খুব দ্রুততার সাথে পারফর্ম করে। Google Tensor SoC হচ্ছে এই ডেটা সেন্টার গুলেতে ব্যবহারিত TPU গুলোর স্কেল্ড ডাউন সংস্করণ। ধারণা করা হচ্ছে এই Tensor SoC গুলো পিক্সেল ফোনের HDR ছবি, ভিডিও এবং স্পিচ রিলেটেড কাজ যেমন: টেক্সট টু স্পিচ, স্পিচ টু টেক্সট, গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট, এম্বিয়ান্ট কম্পিউটিং ইত্যাদি দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করতে সাহায্য করবে।
পিক্সেল ৬ ও পিক্সেল ৬ প্রো এর বিশেষ সুবিধা

নতুন ক্যামেরা হার্ডওয়্যার নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিবে
গুগলের দাবি অনুসারে পিক্সেল ৬ এর এই নতুন প্রাইমারি ক্যামেরা সেন্সরটি পূর্ববর্তী পিক্সেল ৫ ক্যামেরা সেন্সর থেকে ১৫০% বেশি প্রাকৃতিক আলো নিতে পারে। এর ফলে স্টিল ফটো ক্যাটাগরিতে আরো বেশি ডিটেইলস সহ শার্প ছবি পাওয়া যাবে। পর্ট্রেইট ছবিতেও আসবে নতুন মাত্রা। এছাড়াও নাইট মোডে আরো পরিষ্কার ছবি পাওয়া যাবে।
কম্পিউটেশনাল ফটোগ্রাফির ম্যাজিক আসবে ভিডিওতে
তাছাড়া Tensor চিপের কারণে সব ধরণের ছবি ও ভিডিও তে প্রসেসিং টাইমও কমে আসবে। এছাড়াও এই নতুন সেন্সর সহ চিপটি পিক্সেল ফোনের ভিডিও কোয়ালিটিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিং দিয়ে ব্যাপক উন্নতি করতে সাহায্য করবে যা বরাবরই পিক্সেল ফোন গুলোর দুর্বলতা ছিল।
আরো থাকছে নতুন ইন্টিগ্রেটেড সিকিউরিটি মডিউল আর “অল ডে ব্যাটারি”
নতুন চিপটিতে গুগল তাদের আপগ্রেড করা Titan M2 সিকিউরিটি মডিউল ইউজ করেছে। গুগলের দাবি পিক্সেল ৬ ও ৬ প্রো হতে যাচ্ছে সবচাইতে বেশি লেয়ারের হার্ডওয়্যার সিকিউরিটি যুক্ত স্মার্টফোন। এছাড়া এই ফোনটিতে গুগল প্রথমবারের মতো ইন-ডিসপ্লে ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিডার ইউজ করছে। গুগলের প্রত্যাশা অনুসারে এই ফোন গুলো হবে “অল ডে” ফোন। মনে সারাদিন অফিস করে বাসায় যাওয়ার আগেই ব্যাটারি শেষ হয়ে যাওয়ার সমস্যা এইবার থাকবে না। তবে গুগলের এই দাবি বাস্তবে পরীক্ষা না করে বলা যাবে না।
গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট অফলাইনে অনেক সমস্যার সমাধান দিতে পারবে

গুগল আরও দাবি করছে এই চিপটি তাদের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিং মডেল ফোনের চিপ থেকেই রান করার ক্ষমতা দেবে। এর ফলে গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট আরো দ্রুত কাজ করতে পারবে এবং বারবার সার্ভারে রিকোয়েস্ট বা কুয়েরি পাঠানোর প্রয়োজন পড়বে না। তাছাড়া কিছু কিছু কাজ গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট অফলাইনে থাকলেও করতে পারবে। ফলে অনেক সময় বাঁচবে। আর ফোন আরেকটু দ্রুত কাজ করতে পারবে।
অ্যাপল এর পর্যায়ের ইন্টিগ্রেশন
বলা হচ্ছে Google Tensor আর Pixel 6 Series দিয়ে গুগল অ্যাপল এর মতোই হার্ডওয়্যার – সফটওয়্যার ইন্টিগ্রেশন এর দিকে যাচ্ছে। প্রপারলি এই ইন্টিগ্রেশন করতে পারলে গুগল অ্যাপল এর মতোই ৫ থেকে ৬ বছর পর্যন্ত ফোনে সফটওয়্যার সাপোর্ট দিয়ে যেতে পারবে। এই মুহূর্তে রিউমার হচ্ছে গুগল Pixel 6 Series কে ৫ বছর পর্যন্ত সফটওয়্যার সাপোর্ট দিয়ে যাবে। এটা পিক্সেল ৬ ফোন ইউজারদের জন্য একটা বিশাল বিজয় হিসেবেই দেখা হবে কারণ আর কোনো অ্যান্ড্রয়েড ওইএম এত লম্বা সময় পর্যন্ত সফটওয়্যার সাপোর্ট দিচ্ছে না।
গুগল পিক্সেল ৬ ও পিক্সেল ৬ প্রো এর স্পেকশিট
| পিক্সেল ৬ প্রো | পিক্সেল ৬ | |
| ডিসপ্লে ও রেজ্যুলেশন | ৬.৭ ইঞ্চি QHD+ কার্ভভ এজ ডিসপ্লে (১৪৪০ পি রেজ্যুলেশন) | ৬.৪ ইঞ্চি FHD+ ফ্ল্যাট ডিসপ্লে (১০৮০ পি রেজ্যুলেশন) |
| রিফ্রেশ রেট | ১২০ হার্জ | ৯০ হার্জ |
| SoC | Google Tensor | Google Tensor |
| অপারেটিং সিস্টেম | অ্যান্ড্রয়েড ১২ | অ্যান্ড্রয়েড ১২ |
| RAM1 | ১২ গিগাবাইট | ৮ গিগাবাইট |
| Storage1 | ১২৮, ২৫৬, ৫১২ গিগাবাইট | ১২৮, ২৫৬ গিগাবাইট |
| প্রাইমারি ক্যামেরা | ৫০ মেগা পিক্সেল | ৫০ মেগা পিক্সেল |
| আল্ট্রা ওয়াইড ক্যামেরা | বিস্তারিত অজানা | বিস্তারিত অজানা |
| টেলিফটো | ফোর এক্স | নেই |
| ফ্রন্ট ক্যামেরা1 | ১২ মেগা পিক্সেল | ৮ মেগা পিক্সেল |
| সিকিউরিটি | Titan M2 | Titan M2 |
1 ফ্রন্ট পেজ টেক এর লিকড ইনফরমেশন, গুগল থেকে দেওয়া কিংবা কনফার্ম করা না।
বিল্ড কোয়ালিটি, কালার ও পারফরমেন্স

পিক্সেল ৬ ও পিক্সেল ৬ প্রো ফ্রন্ট আর ব্যাক হবে গ্লাসের, সাথে থাকবে এলুমিনিয়াম ফ্রেম। সেন্টার্ড পাঞ্চ হোল ক্যামেরা থাকবে ফ্রন্টে। চিকন বেজল এর এই ফোন গুলো লঞ্চ হবে তিনটি “ফান কালারে। কিন্তু এই ফোনের রিয়েল লাইফ পারফরমেন্স কেমন হবে সেটা নিয়ে গুগল স্পেসিফিক কিছুই বলে নি। তবে রিউমার হচ্ছে এই ফোন গুলোর পারফরমেন্স হবে Samsung এর Exynos 2100 এর কাছাকাছি বা এর থেকে কিছুটা বেশি। বলে রাখা ভালো এই বছরের শুরুতে Samsung Galaxy S21 Series গ্লোবাল লঞ্চ হয়েছে এই Exynos 2100 চিপসেট দিয়ে। এছাড়াও Google Tensor SoC বানানো হচ্ছে স্যামসাং এর 5nm ফ্যাবৃকেশন প্রসেস ব্যবহার করে। এই সেম 5nm প্রসেস ব্যবহার করে Qualcomm Snapdragon 888 বানানো হয়েছে।
আমাদের জীবনের আদ্যোপান্ত জড়িয়ে আছে গুগল। গুগল সার্চ, গুগল ড্রাইভ, গুগল ফটোস, অ্যান্ড্রয়েড, জিমেইল ও গুগল ক্রোম ব্রাউজারের মতো সার্ভিস দিয়ে গুগল এই অবস্থানে এসেছে। পিক্সেল নিয়েও তাই গুগলের কাছে অনেকের প্রত্যাশা একটু বেশি। তবে বাস্তবে পিক্সেল ৬ সিরিজ কেমন হবে, প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির কতখানি মিল হবে সেটা ফোন লঞ্চ হবার পরই বোঝা যাবে।
যেসব দেশে শুরু থেকেই পাওয়া যাবে
শুরুতে মাত্র ৮ টি দেশে লঞ্চ হচ্ছে পিক্সেল ৬ ও পিক্সেল ৬ প্রো। দেশগুলো হলো:
- অস্ট্রেলিয়া
- ক্যানাডা
- ফ্রান্স
- জার্মানি
- তাইওয়ান
- জাপান
- যুক্তরাষ্ট্র
- যুক্তরাষ্ট্র
ফোনগুলো কবে লঞ্চ হবে সে সম্পর্কে গুগল এখনই কিছু জানাচ্ছে না। তবে এর আগে Google I/O 2021 অনুযায়ী অ্যান্ড্রয়েড ১২, সেপ্টেম্বরের ৩০ থেকে অক্টোবরের শুরুর দিকে কোনো এক সময় অফিসিয়ালি লঞ্চ হবে বলে অনুমান করা হয়েছিল। এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে এই অনুমানও করা হচ্ছে যে, ওই সময়ই গুগল অনলাইন ইভেন্টে এর মাধ্যমে এই পিক্সেল ৬ সিরিজ ও অ্যান্ড্রয়েড ১২ অফিসিয়ালি লঞ্চ করবে।
রিসোর্স
https://blog.google/products/pixel/google-tensor-debuts-new-pixel-6-fall/
https://www.theverge.com/2021/8/2/22605094/google-pixel-6-pro-tensor-processor-specs-ai-ml
https://gizmodo.com/pixel-6-preview-heres-what-googles-first-smartphone-ch-1847395579

মন্তব্য করুন
মন্তব্য করার জন্য আপনাকে অবশ্যই লগইন করতে হবে।